অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাস পূর্ণ করেছে। এই সময়কালে সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়ে প্রশাসনকে আরও দক্ষ ও জনবান্ধব করার উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষত, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে।
বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়নের পথে। পাশাপাশি, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও ডিজিটালাইজেশন
বিচার ব্যবস্থার কার্যক্রম সহজ করতে ৩৬ ধরনের নথিপত্র অনলাইনে সত্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, যা জনগণের অর্থ ও সময়ের সাশ্রয় করছে। এ ছাড়া, মডেল ই-কোর্ট ও মডেল সাব-রেজিস্ট্রি অফিস স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে মামলা দায়ের থেকে রায় ঘোষণার প্রতিটি ধাপ ডিজিটাল মাধ্যমে সম্পন্ন হবে।
রাজনৈতিক মামলার পর্যালোচনা ও বিচার বিভাগীয় সংস্কার
পূর্ববর্তী সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে করা ‘গায়েবি’ মামলা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেগুলো প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন তাদের ২৮ দফা সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে, যা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ থেকে শুরু করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
আইন সংস্কার ও নতুন উদ্যোগ
আইন মন্ত্রণালয় বিদ্যমান আইনগুলোর আধুনিকায়নের জন্য কাজ করছে। সাইবার আইন সংশোধনের বিষয়ে আলোচনা চলছে, যেখানে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া, বিবাহ নিবন্ধনে আরোপিত কর বাতিল করা হয়েছে এবং এটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও মানবাধিকার ইস্যু
গত জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নতুনভাবে গঠন করা হয়েছে। বিচার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ১১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে এবং কয়েকজন অভিযুক্ত বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
প্রশাসনিক কাঠামোর সম্প্রসারণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন আদালত ভবন নির্মাণ এবং বিদ্যমান ভবনগুলোর সম্প্রসারণের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ২৩ জেলার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, ৬টি চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, ৫টি মহানগর দায়রা জজ এবং ১০টি জেলা জজ আদালত ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
উন্নত বিচারিক সেবা নিশ্চিতকরণ
সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতে নতুন বিচারক নিয়োগের পাশাপাশি সরকারি আইন কর্মকর্তাদের জন্য একটি স্থায়ী এটর্নি সার্ভিস গঠনের কাজ চলছে। এ ছাড়া, বিচার বিভাগের কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সম্পদ বিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা বাড়াবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এই ছয় মাসের কার্যক্রম প্রশাসনের কাঠামোগত পরিবর্তন এবং বিচার ব্যবস্থার দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রমগুলো দীর্ঘমেয়াদে বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।